বিয়ের অনুষ্ঠানে বা আসরে স্বামী তার স্ত্রীকে মর্যাদা স্বরুপ যে অর্থ-সম্পদ বা সোনা-রুপা দেওয়ার প্রতিঙ্গা করে তাকে দেনমোহর বলে।
প্রত্যেক পুরুষকে বিয়ের সময় নারীকে দেনমোহর দিয়ে বিয়ে করতে হয়। দেনমোহর স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দয়া বা করুণা নয় এটা স্ত্রীর অধিকার। দেনমোহরের টাকা স্বামী তার স্ত্রীকে পরিশোধ করতে বাধ্য। স্ত্রী যদি স্বামীর কাছে দেনমোহরের টাকা দাবি করে এবং স্বামী যদি দেনমোহর পরিশোধ না করে তখন স্ত্রী চাইলে স্বামীর অধিকার অর্থাৎ সহবাসে যেতে অস্বীকার করতে পারেন।
স্ত্রী চাইলে আলাদা থাকতে পারবে এবং স্বামী কে অবশ্যই তার ভরণ-পোষণের খরচ দিতে হবে। দেনমোহর স্ত্রীর কাছে স্বামীর ঋণ। এটা অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে, স্ত্রী যদি দাবি না করে থাকে তবুও স্ত্রীকে তার প্রাপ্য দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে।
মোহরানা কত টাকা বা কি পরিমান সম্পদ দিতে হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে বেঁধে দেয়া হয়নি। একবার দেনমোহরের পরিমাণ ঠিক হয়ে গেলে তা আর কমানো যায় না আবার বাড়ানো যায় না।
বর্তমান সময়ে দেনমোহর ধরার ক্ষেত্রে বরের আর্থিক অবস্থার দিকটা বিবেচনা করা হয় না। বরের উপর এক প্রকার চাপিয়ে দেয়া হয়। ফলে সেই মোহরের অর্থ বাকি থেকে যায় যা পরবর্তীতে ফাকিতে পরিণত হয়।
অনেক সময় আমাদের সমাজে স্ত্রীর পিতার অর্থ সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
দেনমোহর কত টাকা দিতে হবে তা বিয়ের অনুষ্ঠানে বা আসরে নির্ধারণ করতে হয়। তবে সবচেয়ে ভালো হয় যদি বিয়ের তারিখ ঠিক করার আগে উভয় পক্ষ আলোচনা করে দেনমোহর ধার্য্য করা। দাম্পত্য মিলন, তালাক-বিচ্ছেদ অথবা স্বামী-স্ত্রী মৃত্যুর ধারা নিশ্চিত হয় এই দেনমোহর।
দেনমোহরের দুটি অংশ
যথাঃ
- মুয়াজ্জল বা আশু দেনমোহর – বিয়ের আসরে স্ত্রীকে নগদ দিতে হয়। বিয়ের দিন নিতে না পারলে সাংসারিক জীবন চলাকালীন সময়ে দেনমোহরের অংশ দুই স্ত্রী চাওয়া মাত্র স্বামী পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে।
- এবং মু-অজ্জল বা বিলম্বিত দেনমোহর – স্বামী মৃত্যুর পর অথবা স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে গেলে বা তালাক হয়ে গেলে দেনমোহর যে অংশ পেয়ে থাকে।
স্বামী-স্ত্রীর মোহরানার দায়িত্ব যদি কোন ব্যক্তি নিয়ে থাকে তবে সে তা পরিশোধের জন্য দায়ী হবে। স্ত্রীর আগে যদি স্বামী মারা যায়, আর যদি দেনমোহর পরিশোধ বাকি থাকে।
তাহলে স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। আর যদি দেনমোহর পরিশোধে ব্যর্থ হয় তাহলে স্ত্রী চাইলে স্বামীর সম্পত্তি দখল করতে পারেন। যদি স্ত্রী আগে মারা যায় তাহলে স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা দেনমোহর পাওয়ার অধিকারী।
ইসলামে দেনমোহরের টাকা বিয়ের দিনই পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। স্ত্রীর সাথে প্রথম সহবাসের আগে দেনমোহর পরিশোধ করা উত্তম। দেনমোহর বাকি রেখে সংসার করা যাবে না এটা দেনমোহরের সাথে সাংঘর্ষিক।
যদি কোন কারণে স্বামী দেনমোহর দিতে না চায় অথবা অস্বীকার করে তাহলে স্ত্রী পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারবেন।
স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক দেয় অবশ্যই দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে হবে আবার স্ত্রী যদি স্বামীকে তালাক দেয় তাহলেও দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে হয়।
মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন ১৯৩৯ সাল
এখানে ধারা ৫-এ বলা হয়েছে যে কারণেই তালাক হোক না কেন স্ত্রীর দেনমোহরের প্রাপ্তির অধিকার ক্ষুন্ন করা হবে না।
মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন ১৯৬১ সাল
এই পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে সালিশি পরিষদের অনুমতি ছাড়া যদি কেউ আরেকটি বিয়ে করে তাহলে তার বর্তমান স্ত্রীর প্রাপ্য দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। আর যদি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে বকেয়া রাজস্ব এর মত আদায় হবে।
যদি কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে দামি দামি উপহার দেয় আর সেটাকে দেনমোহর বলে চালিয়ে দেয় তাহলে দেনমোহর আদায় হবে না। কিন্তু যদি স্ত্রীর অনুমতি বা মত নিয়ে দিয়ে থাকে তাহলে দেনমোহর আদায় হবে।
আবার অনেকে আছে যারা ব্যাংকে স্ত্রীর নামে টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখে সেটাকে দেনমোহর বলে চালিয়ে দেয় এটাও দেনমোহর হিসেবে গণ্য হবে না। কিন্তু যদি স্ত্রীর ওই টাকার উপর পুরোপুরি অধিকার থাকে বা স্ত্রী যদি তার ইচ্ছামত খরচ করতে পারে তাহলে দেনমোহর হিসেবে গণ্য হবে।
অনেক স্বামী বিয়ের দিন রাতে বাসর ঘরে স্ত্রীর কাছ থেকে দেনমোহর মাফ করিয়ে নেয়। আবার অনেকেই স্বামী মারা যাওয়ার পর স্ত্রীকে দেনমোহর মাফ করে দিতে বলে। এভাবে দেনমোহর মাফ হয়ে যায় না।
শুধুমাত্র কোনরকম চাপ, হুমকি, ছলনা ছাড়া এবং স্বামী যদি গরীব বা অসচ্ছল হয় সে কারণে স্ত্রী যদি নিজ ইচ্ছায় দেনমোহর মাফ করে দেয় তাহলেই স্বামী তা থেকে মুক্তি পাবে।